বিশেষ সাক্ষাৎকারে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন

সবুজ সুন্দর সমৃদ্ধ নগর গড়তে চাই

প্রকাশিত: ১২:৩২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২২

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নারী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু। ২০১১ সালে নাসিক গঠনের পর পান মেয়রের দায়িত্ব। নয়াদেশ এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দেশের প্রথম নারী মেয়র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার।

নয়াদেশঃ- টানা তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। আপনার জনপ্রিয়তার কারণ কী?

আইভীঃ এর সঠিক কারণ বলতে পারবেন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ, যারা আমাকে বারবার ভোট দিয়ে তাদের অভিভাবক নির্বাচিত করেছেন। তবে যে কথাটি বলতে পারি তা হলো, আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছি। আস্থার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি।  জনগণকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। ঈমান ও আমানতদারি বজায় রেখেছি। হয়তো এ কারণেই তারা আমাকে বারবার নির্বাচিত করেছেন।

নয়াদেশঃ- নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে সবসময় উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা-শঙ্কা থাকে। এর কারণ কী?

আইভীঃ আমি যতবার নির্বাচন করেছি, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই সম্পন্ন হয়েছে। ২০০৩ সালে যখন পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করি, তখনো শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। এরপর ২০১১ ও ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের এ নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন। ইলেকশনের আগে নানারকম কথাবার্তা হয়। নানারকম ইকুয়েশন, মেকানিজম, একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হয়ে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের আগে এসব কথাবার্তা চলতে থাকে। শঙ্কা-ভয় অনেক কিছুই থাকে। কিন্তু নির্বাচনের দিন সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা সুন্দরই হয়। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মানুষ ভোট দিতে আসে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর থাকে। প্রার্থীরাও চায় সুষ্ঠু-সুন্দর-উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হোক। আমি মনে করি, প্রতিবারই নির্বাচনের দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে।

নয়াদেশঃ পরাজিত প্রার্থীর বাড়ি গিয়ে মিষ্টি খাওয়ানোর বিষয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই?

আইভীঃ এটা আমি সবসময়ই করি। ২০০৩ সালেও কিন্তু নুরুল ইসলাম সর্দার ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। ২০১৬ সালে সাখাওয়াত ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে সকালে নাশতা খেয়েছি, আমি তাকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছি। এবার তৈমুর আলম তো আমার কাকা হন। পারিবারিক বন্ধনটাও আমাদের শক্তিশালী। তার বাসায় তো যেতে হবেই। আমরা তো একই শহরে বসবাস করি। নির্বাচনের সময় অনেক কথা হয়, নানা কথা বলি, নানা কথা শুনি। কিন্তু বিজয়ের পর তো আর কিছু মনে রাখা ঠিক না। তার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চেষ্টা করি। পরামর্শ নেই। এতে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা গড়ে ওঠে।

নয়াদেশঃ রাজনীতিবিদদের মধ্যে এখনো এমন চর্চা গড়ে না ওঠার কারণ কী?

আইভীঃ- আমাদের সবারই একটু সহনশীল হয়ে রাজনীতি করতে হবে। আমরা রাজনীতি করি কেন? দেশের জন্য। দেশের মানুষের জন্য। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। উন্নয়নের জন্য। আশা করি, রাজনীতিতে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা আরো বাড়বে, একটু সময় লাগবে হয়তো।

নয়াদেশঃ- নতুন মেয়াদে কোন কাজগুলো বেশি গুরুত্ব দেবেন?

আইভীঃ- অনেক কাজই আছে যেগুলোয় গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশেষ করে চলমান কাজগুলো শেষ করব। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, কদমরসুলের ব্রিজ সম্পন্ন করা। আশা করি খুব দ্রুত শেষ করতে পারব। এরপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ও গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চীনা একটা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এছাড়াও পুকুর-জলাশয়-জলাধার সংরক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য বহুতল আবাসন, নগর ভবনের নতুন বিল্ডিং নির্মাণের মতো ছয়টি মেগা প্রজেক্ট আছে। সেগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করাতে চাই।

নয়াদেশঃ- গত ১০ বছরে উন্নয়নমূলক নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক ভোগান্তি রয়ে গেছে। এ ভোগান্তি কমবে কি?

আইভীঃ- আমাদের দেশে এখন প্রচুর উন্নয়নকাজ চলছে। আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি, মানুষ বাড়ি-ঘর করছে কিংবা কেউ একটা কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে, রাস্তাতেই বালি-ইট রেখে কাজ করছে। এটাও কিন্তু এক ধরনের নাগরিক ভোগান্তি। এমন আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এগুলো থাকবেই। পর্যায়ক্রমে এগুলো কমিয়ে আনতে হবে। একদিনে সব সমস্যা কমে যাবে না। আমরাও উন্নতির দিকে যাচ্ছি, মানসিকতাও পরিবর্তন হচ্ছে। যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো আস্তে আস্তে কমে আসবে বলে আশা করছি।নয়াদেশঃ- হকার-যানজটমুক্ত নগর গড়তে কী পরিকল্পনা করেছেন?

আইভীঃ- যানজট নিরসন করা একটু কঠিন। কারণ এটা মেয়রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু নগরবাসী মনে করে এটা আমার দায়িত্ব। যানজট নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা বিভাগ আছে। ট্রাফিক বিভাগ এটা নিয়ে কাজ করে। আমরা সহযোগিতা করব। বাস-ট্রাকস্ট্যান্ড স্থাপন করা নাসিকের দায়িত্ব। আমরা যথাযথ চেষ্টা করছি। যানজটের বড় একটা কারণ হলো দিনের বেলা ট্রাক চলে। আমরা বহুবার নিষেধ করেছি। কিন্তু চলছেই। প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। সর্বোপরি যানজট নিরসন একটি সমন্বিত কার্যক্রম। আমরা যখন মিটিং করি, কিছুদিন সব ঠিক থাকে, তারপর আবার কেন যেন থেমে যায়। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে যানজট কমে আসবে আশা করছি।

নয়াদেশঃ – এবারো কি ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট হবে?

আইভীঃ- অ্যাসেসমেন্ট মাত্র হয়ে গেল। আর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ট্যাক্স আমরা বাড়াইনি। আগে যা ছিল সেটাই রেখেছি। আসলে দীর্ঘদিন তো এ শহরে ট্যাক্স তোলা হয়নি, আমার আগে আরো ১৮ বছর এখানে প্রশাসন ছিল, কিন্তু ট্যাক্স আদায় করেনি। ওই সময়ের অনিয়মগুলো নিয়মের মধ্যে আনতেই আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মানুষ কিন্তু খুব একটা অভিযোগ করেনি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনের আগে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা বলেছি, যাদের অসুবিধা আছে, ১৫ শতাংশ ট্যাক্স কমিয়ে দেব। কভিডের সময়ও ট্যাক্স ছাড় দিয়েছি।

নয়াদেশঃ – আপনি বলেছেন, ট্যাক্স বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে মেয়রের কোনো হাত নেই, মন্ত্রণালয় তা নির্ধারণ করে দেয়।

আইভীঃ- আমি এভাবে কথাটা বলিনি। আমি বলেছি, নিয়মের বাইরে ট্যাক্স বাড়ানোর ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। আরেকটা বিষয় হলো, ঢাকা বা চট্টগ্রাম সিটির ট্যাক্সের সঙ্গে নাসিকের ট্যাক্সের তুলনা করলে চলবে না। ঢাকার সমস্যা হলো, দীর্ঘদিন মামলার কারণে তাদের কোথাও কোথাও ট্যাক্স জটিলতা রয়ে গেছে। আমাদের সে সমস্যা নেই।

নয়াদেশঃ- শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে কী করবেন?

আইভীঃ- আমরা ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করেছি। ব্যবসায়ীসহ সব ধরনের নাগরিকের জন্যই আমরা সেবা দিয়ে আসছি। এটাকে আরো প্রমোট করতে হবে। সে কাজটা এখন করে যেতে হবে।

নয়াদেশঃ- ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা কোনো সেবা দিচ্ছেন কিনা?

আইভীঃ- ব্যবসায়ীদের যদি কোনো সমস্যা থাকে, তারা আমাকে বললে সেটা সমাধান করে দিতে পারি। নয়তো নাগরিক সেবা তো সবার জন্যই সমান।

নয়াদেশঃ- চাঁদাবাজির বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আছে। কিশোর গ্যাংও নগরীর বড় সমস্যা। সমাধানে কী করবেন?

আইভীঃ- আমি ঠিক জানি না কোথায় চাঁদাবাজি হয়। তবে আমার জানা মতে, অনেক জায়গাতেই এখন চাঁদাবাজি হয় না। কোথায় হয় সুনির্দিষ্ট করে জানালে সবার সঙ্গে কথা বলে আমি ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করব। আর কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে আমি বহুবার বলে এসেছি। নির্বাচনী প্রচারণায়ও বারবার বলেছি। তাদের ব্যাপারে প্রশাসন একটা ব্যবস্থা অবশ্যই নেবে এটা আমি আশা করি।

নয়াদেশঃ- গত ১০ বছরে করতে পারেননি এমন কয়েকটি কাজ সম্পর্কে যদি বলতেন।

আইভীঃ- করা উচিত, কিন্ত করতে পারিনি যা, সেটি হলো কদমরসুল ব্রিজ। ২০১১ সালে আমার নির্বাচনী ওয়াদা ছিল ব্রিজটি করব, তখন কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু কাজ গোছাতে, একনেকে পাস করতে এত সময় লেগে গেছে। আশা করি, এবার করতে পারব।

নয়াদেশঃ- পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ার স্লোগান দিয়েছেন এবার। এ নিয়ে বিশেষ কী পরিকল্পনা আছে?

আইভীঃ- গত দুই মেয়াদে আমি নগরীর সবগুলো খাল অগ্রাধিকার দিয়ে খনন করছি। ৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সিদ্ধিরগঞ্জ লেক খনন করেছি। সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। পুকুর খনন করে বাঁধাই করেছি। জলাবদ্ধতা দূর করার চেষ্টা করেছি। ভারি বর্ষণ হলে আধা ঘণ্টার মধ্যে পানি চলে যায়। এখন শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত যাতে না হয়, সেজন্য ইটিপিতে শোধন করে ড্রেনের পানি নদীতে দিতে চাচ্ছি। শীতলক্ষ্যার পাড় বাঁধাই করে দেব। ১৬টি খেলার মাঠ করেছি। আরো খেলার মাঠ ও বৃক্ষরোপণ এবং পার্ক নির্মাণের মাধ্যমে সবুজ নারায়ণগঞ্জ গড়ে তুলব।

নয়াদেশঃ আগামী নির্বাচনের আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনকে কোন অবস্থায় নিয়ে যেতে চান?

আইভীঃ- পাঁচ বছর তো অনেক লম্বা সময়। ওই পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আরো কাজ করতে চাই। সবুজ সুন্দর সমৃদ্ধ নগর গড়তে চাই।