শাহানাজ শাহীন-এর ছোট গল্প

প্রকাশিত: ৪:৩৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১

নির্জন পথে

চৈত্রের কোন এক তপ্ত দুপুরে ৷ আমরা তিন সহপাঠি স্কুল হতে বাড়ি ফিরছিলাম ৷ গ্রামের স্কুল ৷ কাঁচা মেঠো পথ ৷ দু পথেই যাতায়ত করা যায় ৷ একটি উঁচু পথে ৷ অন্যটি উঁচু পথ থেকে নীচে ঢাল দিয়ে নেমেছে ৷ গ্রাম্য ভাষায় বলে নামা দিয়ে ৷ নামা দিয়ে যে পথটি তার একপাশে জলাশয় আর অপর পাশে হীজল গাছ ও বাঁশের ঝাড় ৷
মাঝখান দিয়ে চিকন সরু পথ চলে গেছে গ্রামের মধ্যে ৷
একমাত্র গরমের সময় এই পথে লোকজন আসা যাওয়া করে ৷ বিশেষ করে হাঁটবারে ৷ বাকি সময়ে
বর্ষার পানির নীচে তলিয়ে থাকে ৷ জঙ্গা আর জলাশয় বলে কাছাকাছি ঘরবাড়ি নেই ৷ মিনিট দশেক হাঁটার পর প্রথম যে বাড়িটি তা নাজীর খাঁয়ের ৷ গ্রামের লোকজন খাঁন না বলে খাঁ বলে ৷
তারপরের বাড়িটা মেম্বার বাড়ী ৷
হাঁটবার ছাড়া এইাপথে লোকজন কম চলাচল করে ৷ আমরা প্রায়ই এ পথে বাড়ি ফিরি ৷
আজকেও তাই করলাম ৷
উপর থেকে দৌড়ে নীচে নামছি আমরা তিন বন্ধু ৷
দৌড়ের বেগ অনেক দ্রুত ৷
ঢালো বলে গতি কমানোর কোন উপায় নেই ৷
আমরা একই পদ্ধতিতে তিনজনই নেমে এলাম নীচে ৷ আমাদের গতি যেখানে থামলো ,ঠিক সেখানটায় ৷
পথের ধারে পিছ মুখো হয়ে একজন কুঁজো হয়ে বসে আছেন ৷ খাঁলি গায়ে ৷ মাথার উপরে একখানা গামছা দিয়ে ঢাকা ৷ লাল নীল নানান চেকের গামছা ৷
পুরুনো একখানা গামছা ৷ দৃষ্টি তার সামনের ডোবার দিকে ৷
আমাদের চোখ আঁচমকা তার দিকে পড়লো ৷
তিনি দেখতে অনেকটা আমাদের গৃহ শিক্ষকের মতোই ৷
আমাদের বলতে আমরা দুই বোন ৷ আমি আর আমার বড় বোন ইনা ৷ আমরা একই ক্লাশে পড়তাম ৷ দেড় বছরের ছোট বড় আমরা ৷ তবে দেখতে একই বয়সী মনে হতো ৷ পাড়ার লোকজন জমজ বোন বলেই ভাবতো আমাদের ৷ সারাক্ষণ একসাথে থাকতাম বলে প্রতিবেশীরা নারিকেলের জোড়া বলে ডাকতেন আমাদের ৷
ইনার অবশ্য আরেকটি নাম ছিলো ৷ এক প্রতিবেশী নামটি দিয়েছিলো ৷ নামটি হলো গাউছা বুড়ি ৷ আমাদের বাড়িতে নানান গাছগাছালী ছিলো।
সে দিনের বেশীরভাগ সময়ে গাছে চড়ে বেড়াতো ৷ সেই থেকে গাউছা বুড়ি তাঁর নাম হয়ে গেল ৷ যিনি নাম দিয়েছেন উনার নাম মনে করতে পারছি না ।
প্রায় দুই যোগ আগের কথা । তাঁর বাবা ছিলেন ডাক্তার  । তাঁর বাবরি চুল ছিল বলে গ্রামের লোকজন তাঁকে চুইলা ডাক্তার বলে ডাকতেন ।
আমাদের বাড়ির কোণায়, পথের ধারে
একটা কাঠাল গাছ ছিলো ৷
ইনাকে প্রতিবেশী প্রায় সময়ই গাছে দেখতো ৷
এই হলাম আমরা দুজন ৷ বাকি রইলো রীমা ৷
ঐ দুপুরে আমরা এই তিনজনই ছিলাম ৷
আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে তিনি আমাদের শিক্ষক ভর দুপুরে এখানে জলাশয়ের ধারে বসে আছেন ৷ নিশ্চিত হতে খানিকটা এগিয়ে গেলাম ৷
উনার খুব কাছাকাছি ৷ একেবারে গাঁ ঘেসে ৷
ইনা সামনে ৷ আমি আর রীমা ইনার পিছনে দাঁড়ানো ৷
ইনা জিজ্ঞেস করলো ” স্যার ? স্যার , এই স্যার ” ৷
বসে থাকা লোকটি তেমনি বসে আছেন ৷
ইনা উত্তর না পেয়ে , খানিকটা কুঁজো হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো ” স্যার কি করেন ? স্যার ? ও স্যার ?
বসে থাকা লোকটি এবার মুখ তুললেন নিঃশব্দে ৷ আমরা তার মুখের একাংশ দেখতে পেলাম ৷
বসন্ত রোগীর মত মুখ ভর্তি ছোপ ছোপ দাগ ৷
ভাবলেশ হীন ৷ জীবন্ত লাশের মত ৷
আমিই প্রথম চিৎকার দিলাম
” ওমাগো ভূত , এটা ভূত ৷ মানুষ না ৷
আমরা তিন জনই দৌঁড়াতে লাগলাম ৷ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নাজিরখাঁর বাড়ির কাছে এসে থামলাম ৷
আপাতত এখানে ভয়ের কিছু নেই ৷ আশে পাশে লোকালয় ৷ আমরা চিৎকার দিলে তারা শুনতে পাবেন ৷ তাছাড়া আমরাও তিনজন একসাথে ৷
তবে বেজোড় ৷ শুনেছি ভূতপ্রেতদের বেজোড় সংখ্যা পছন্দের ৷
জীবন নিয়ে দৌড়ে আমরা ক্লান্ত ৷ মিনিট তিনেক দম নিলাম ৷ তারপর আবার যেখান থেকে মরণ ভয়ে পালালাম সেখানটা দেখার চেষ্টা করলাম ৷
আমরা দূর থেকে দেখলাম ৷ জায়গাটি খালি ৷ সেখানে কেউ বসে নেই ৷ মাত্র মিনিট তিনেকের ব্যবধান ৷
বুজলাম তিনি সত্যিই মানুষ ছিলেন না৷
ভূত দেখার আনন্দ ও ভয় দুটিকে সঙ্গে নিয়ে
বাড়ি ফিরে গেলাম ৷ বিকেলে মাস্টার মশাই এলেন ৷ আমরা অধীর আগ্রহে আজ উনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম ৷ সত্যকে উৎঘাটন করতে৷
যার সাক্ষী আমরা তিনজন ৷
” —মাস্টার মশাই মাস্টার মশাই আজ দুপুরে
বিলের ধারে কি করছিলেন ? ”
—আমি !
—হ্যাঁ আপনি !
—আমি কি করছিলাম ? মাস্টার মশাই হাঁসছেন
—আপনি কুঁজো হয়ে বসেছিলেন ৷
কোন কথা বলেননি ৷
—তাই ? তোমরা ভয় পেয়েছিলে ?
— না প্রথম ভয় হয়নি ৷
তবে পরে মনে হয়েছে আপনি ভূত ৷
মাস্টার মশাই কেমন যেনো হেয়ালী করছেন ৷
পরিষ্কার করে বলছেন না তিনিই ছিলেন অথবা ছিলেন না ৷ মাস্টার মশাই দুয়ের মধ্যে ছিলেন ৷
আমরা অনেক চেষ্টার পরেও উনার কাছ হতে পরিষ্কার কোন উত্তর পেলাম না ৷
মাষ্টার মশাই চলে গেলেন পরা শেষ করে ৷
সেই রাতে ইনার প্রচন্ড জ্বর এলো ৷ সেই জ্বরে সাঁত দিন ভোগলো সে ৷
মাস্টার মশাইকে জানালাম তিনি না আসতে ৷ ইনার জর ৷ তিনি সাতদিন পর এলেন ৷ এসে বললেন
—গত আটদিন তোমাদের পড়া বাকি ৷ কি অবস্থা তোমাদের পড়ালেখার ?
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরার অবস্থা ৷
সাঁত দিন আগে সেই বিকেলে কে ছিলেন ?
আবারও তাই !