শব্দ দূষণ ॥ জনসচেতনতা ও করণীয়

প্রকাশিত: ৭:৩৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০২২

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ॥
পরিবেশ দূষণ বর্তমানে এক অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। নানাভাবে আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণগুলির মধ্যে শব্দদূষণ একটি। বর্তমানে ঢাকা শহরের শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশংকাজনক। সেটা সমস্যা মনে হলেও আমাদের অসচেতনতার কারণে আমরা প্রায়শ বলে থাকি এটার নিরসন সম্ভব নয়। কিন্তু এ সমস্যাগুলো মানুষেরই তৈরি। আমরা একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানুষের তৈরি এমন একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা হলো শব্দদূষণ। বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে এমনকি বিনোদনের সময়ও আমরা বিভিন্নভাবে শব্দদূষণের শিকার হচ্ছি। বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। বাংলাদেশেও বর্তমানে পরিবেশ দূষণ রোধের বিষয়টি একটি আলোচিত বিষয়। অনেক ব্যক্তি বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি তথা পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছে। প্রচার মাধ্যমগুলোকে এ ব্যাপারে আরো এগিয়ে আসতে হবে। অতি সম্প্রতি পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা জনস্বার্থ তথা পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ। যা সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রচার মাধ্যমগুলো এগিয়ে এসে তা কার্যকর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সময়ে বায়ুদূষণ-পানিদূষণ রোধ এবং বনায়নের বিষয়গুলো আলোচিত হলেও শব্দদূষণ সম্পর্কে আলোচনা বা চিন্তাভাবনার গন্ডি একেবারেই সীমিত। শব্দদূষণের কারণেও মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারনা নেই। বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন এ নিয়ে কিছু কাজ করলেও তা সমস্যার তুলনায় খুবই সামান্য। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে তেমন কোন আইন নেই, ট্রাফিক আইনও যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধ, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার সীমিতকরণসহ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। শব্দদূষণের কিছু মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত, সে সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত গ্রহণ এবং তা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কিছু সুপারিশমালা এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে-যা জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে সহায়ক বলে আমাদের বিশ্বাস। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কাজ করতে আগ্রহী, আশা করি তারাও এ প্রতিবেদন থেকে লাভবান হবেন। আমরা মনে করি জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ঐক্যবদ্ধ কর্ম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দিক নির্দেশনা শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
সাকরাইন উৎসবঃ
শব্দ দূষণ বন্ধে সচেতন হতে হবে। পুরান ঢাকাবাসীর ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন। পৌষসংক্রান্তি উৎসব বা এই সাকরাইনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরের মত এবারও উৎসবের আমেজে সাজে পুরান ঢাকা। তবে, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘুড়ি উড়িয়ে দিবসটি পালন করার কথা থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে ঘুড়ির বদলে বিভিন্ন ভবনের ছাদে আয়োজন করা হয় “ডিজে পার্টি”র। আর এসব পার্টিতে বাজানো উ”চ শব্দের গানের আওয়াজে অতিষ্ঠ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

একটা সময় ছিল, যখন সাকরাইন উৎসব মানেই পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে পৌষের পিঠার ধুম পড়তো। তরুণ-তরুণীরা নতুন পোশাক গায়ে জড়াতো। সারাদিন ঢাকার আকাশে উড়তো ঘুড়ি। কিš‘ সময় বদলে গেছে। সাকরাইন উৎসবও এখন ঢুকে পড়েছে আতশবাজি আর ডিজে পার্টিতে। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব চললেও ঠিক সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই আতশবাজি, বাজি আর ডিজে গানের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরান ঢাকা। উৎসবে বাজি আর ডিজের কান ফাটানো শব্দে অনেকেই বিরক্ত। থার্টি ফাস্ট নাইটে বাজির শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুসহ এক নারীর মৃত্যুর খবর দাগ কেটেছিল মানুষের মনে। এ ছাড়া ফানুসের আগুনে একইসাথে ১০ জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঢাকাবাসীর অজানা নয়। এরপর থেকে দাবি উঠে, ফানুস আর আতশবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এরইমধ্যে এলো সাকরাইন উৎসব। এদিন ফানুস উড়ানো কম দেখা গেলেও আতশবাজি ও ডিজে গানেই উদযাপন হয় উৎসব।

বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কী ধরনের শব্দ দূষণ করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। শব্দ দূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। আর বিশেষ করে ঢাকা শহরে শব্দ দূষণের বহু উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা কোন ক্ষেত্রেই শব্দ দূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। আর তা না মেনে চললে সাজার বিধানও রয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। বাংলাদেশে মাইকের ব্যাবহার খুবই জনপ্রিয়। বেশ কিছুদিন যাবত লাউড স্পিকারও ব্যবহার হচ্ছে।

রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পিকনিক সকল ক্ষেত্রে এর কানফাটানো শব্দ চলে। তবে আইনে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতিও রয়েছে। খোলা জায়গায় বিয়ে, খেলাধুলা, কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোন ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগান ইত্যাদির ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা অতিক্রম করে এমন যন্ত্র ব্যাবহার করা যাবে। তবে তার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় এই শব্দ করা যাবে না এবং রাত দশটার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই শেষ করে ফেলতে হবে।

এসব বিষয় মাথায় রেখে পৌষ-সংক্রান্তি বা সাকরাইন উৎসবের দিন বিকট শব্দের আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারির করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। উৎসব-উদযাপনে আনন্দ হবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অন্যের বিষাদের কারণ না হয়। শব্দ দূষণ বন্ধে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: বাংলা পোস্ট | প্রকাশক: বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা  ও আহবায়ক: জাতীয় জনতা ফোরাম |