প্রসঙ্গঃ ইউপি নির্বাচন বীভৎস্য রূপ আর কতোদূর গড়াবে? প্রকাশিত: ২:৫১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৪, ২০২১ ॥ রিন্টু আনোয়ার ॥ চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা থামছেই না। সংঘর্ষ-সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রতিটি ইউপি নির্বাচনে। ইসি থেকে ভোটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হলেও মাঠ প্রশাসন যেন তা মানছেনইনা। প্রার্থিতা বাতিল ও ভোট বন্ধের নির্দেশনাও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এপর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সহিংসতায়-সংঘর্ষে সাংবাদিক,বিজিবি সদস্যসহ নিহত-আহত হয়েছেন বহু মানুষ। ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, টেঁটাযুদ্ধ,গুলি,মারামারি,ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ নানা অনিয়মের ঘটনাও ঘটেছে প্রতিনিয়ত। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গারাগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম দলিরাম মাঝপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় দুই প্রার্থীর সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে যান। তখন দুইপক্ষের সংঘর্ষে বিজিবি এক নায়েক নিহত হন। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলের বাংলাবাজারে পৃথক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হন ২জন। নরসিংদীর রায়পুরার চান্দেরকান্দিতে ভোট গণনা শেষে সংঘর্ষে নিহত হন ২জন। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগণনার পরে কারচুপির অভিযোগ ও ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত হয়। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ইউপি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র এলাকায় সহিংসতায় মারা যায় ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন সজিব। খুলনার তেরখাদা উপজেলার মধুপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একজন সমর্থকের মৃত্যু হয়। এটি হচ্ছে অতি সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষে মাত্র কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনার চিত্র। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্যমতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৮ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪৮ জন, বিএনপির ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতেও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেসব তথ্য বিবেচনায় রেখে এবারও যাতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে কোনো ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটে সে জন্য কর্তৃপক্ষের করণীয় নিয়ে নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নানা মহল থেকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করা হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য তারপরও ইউপি নির্বাচনে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলছে। স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন-প্রতিটিতেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বের বিষয়টি নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না নির্বাচন বিশ্লেষকরা। মূলত রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে এসব ঘটনার জন্ম হচ্ছে। তবে এই সহিংসতার জন্য প্রার্থী এবং বিশেষ করে সরকারী দলের নেতা-কর্মীদের অসহনশীল মানসিকতায়ই অনেকাংশেই দায়ী। তাই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং প্রার্থীর সমর্থকদের সহনশীল হতে হবে। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা বন্ধ না হলে সহিংসতা কখনওই কমবে না। সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে এখানে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীনরাই এখন নিজেদের প্রতিপক্ষ। অনিবার্যভাবে প্রাণহানির শিকারদের প্রায় সবাই তাদেরই। নেতাকর্মী ক্ষতবিক্ষত হলেও এতে ক্ষমতায় কোনো হেরফের হচ্ছে না। এদিকে নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন, নির্বাচন ভালো হচ্ছে! সামনে আরো ভালো হবে! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ইউপি নির্বাচনে এমন ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে! ডজনে-ডজনে লাশের শোক মিলিয়ে যাচ্ছে শক্তিতে। শোককে শক্তিতে পরিণত করার এ কোন বিকৃতাচার? কোন পাপে-তাপে এ দশায় ঠেকলো নির্বাচন? একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ধারাপাতে এরই মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর সাথে বহু জায়গায় চেয়ারম্যান জিতেছেন বিনা নির্বাচনে। তাই ভোট বা নির্বাচনের কার্যকর কায়কারবার না থাকলেও হতাহতের সংখ্যায় কমতি নেই। এ নিয়ে কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মধ্যে দৃশ্যত বিব্রতভাব ও উদ্বেগ নেই। জনগণের ওপর দায় চাপানোর একটা সুক্ষ্ম চেষ্টা কিন্তু লক্ষণীয়। বলা হচ্ছে, জনগণ সচেতন হলে এমনটি হতো না। দোষ বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টাও আছে। বলার চেষ্টা করা হচ্ছে তারা নির্বাচনে এলে এমনটি হতো না। বাস্তবে ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়াই নির্বাচিত। ভোটের দরকার নেই। জনগণের কাছে যাওয়ার পর্বই ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ভোটের দিন কী হবে-না হবে, মানুষ কেন্দ্রে যাবে-কি যাবে না, এগুলো কোনো বিষয়ই নয়? ভোটের বদলে বন্দুক, চাপাতি, কিরিচ, দা-বঁটি, টেঁটা, লাঠি-সোটায় জেতার মানসিকতা ভর করেছে চরমভাবে। এটিও একটি হিম্মত। দল থেকেও কোথাও কোথাও এমন বাহাদুর খোঁজার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। হিম্মতের প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা প্রতিপক্ষের কান কেটে ফেলছে। হাত-পায়ের রগ কেটে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলছে। এর মাঝে আস্ত মেরে ফেলার ঘটনাতো ঘটছেই। এ বীভৎস্য রূপ আর কতোদূর গড়াবে? হতাহতের সমান্তরালে ‘নৌকায় ভোট না দিলে কবরেও জায়গা হবে না, নৌকায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে আসা নিষেধ’- এ ধরণের প্রকাশ্য হুকুমের বহু ভিডিও ফুটেজও ভাসছে সামাজিক মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনের এ ক্ষেত্রে যেন কোনো দায় নেই? এমন হতাহতের মধ্যেও ধৈর্য্যের সঙ্গে নির্বিকার থাকা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী দপ্তরি, পিয়ন, ঝাড়ুদারকেও পোলিং অফিসার নিয়োগ দেওয়ার সাফল্য আর কোনো কমিশন দেখাতে পারেনি। উপরন্তু, সিইসি একে ‘হঠাৎ ফৌজদারি অপরাধ’ বলে বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করেছেন। তা দায়িত্বের স্বাক্ষর তো নয়ই, সুস্থতাও নয়। নিজেকে বা নিজেদের সফল বলে ফেব্রুয়ারিতে বিদায় নেয়ার সময় কেএম নুরুল হুদার একটু শরমও লাগবে না? জগদ্দল পাথরের মতো এভাবে কমিশনে চেপে বসে মেয়াদ শেষ করার গর্ব করবেন? বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের কোন তালিকায় নাম বসবে তাদের? তারা কেবল “বিব্রত ও উদ্বিগ্ন” হওয়ার মধ্যেই দায়িত্ব পালন করে যাবে? রিন্টু আনোয়ার, সাংবাদিক ও কলামিস্ট ইমেল: rintu108@gmail. com SHARES মতামত বিষয়: